লেখাঃ সাজেদা হোমায়রা
'Beauty with brain' কথাটি আতিকা বিনতে জায়েদ (রা.) -এর সাথে খুব মিলে যায়। একজন নারীকে পছন্দ করতে সাধারণত যেসব গুণ প্রত্যাশিত থাকে, সবকিছুই ছিল তাঁর মধ্যে। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক গুণে সমৃদ্ধ একজন অনন্য সুন্দরী নারী। সৌন্দর্য, দ্বীনদারিতা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতার অসাধারণ সমন্বয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অতুলনীয়।
ইনসাইড এবং আউটসাইড উভয় দিকেই তিনি ছিলেন খুব সুন্দর। তৎকালীন সময়ের মানুষেরা তাকে 'সৌন্দর্যের রানী' হিসেবে অভিহিত করেছেন। সৌন্দর্যের পাশাপাশি তাঁর প্রতিভা ও উদার মানসিকতাও নারী-পুরুষ সবাইকে খুব আকৃষ্ট করতো।
আতিকা (রা.) -এর সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর হৃদয়স্পর্শী কবিতায়। তৎকালীন আরব সমাজে তিনি একজন কবি হিসেবেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন মসজিদ-প্রেমী নারী, যা তাঁর দ্বীনদারিতার পরিচায়ক।
আতিকা (রা.) এতো বেশি সুন্দরী ও প্রতিভাময়ী ছিলেন যে, পথ চলতে চলতেই অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব পেতেন তিনি। যাদের প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করতেন না, তারা গভীর দুঃখ আর বিরহে কাটাতো। তাঁকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া ছিল প্রতিটি পুরুষের জন্য স্বপ্নের মতো।
পাঁচজন পুরুষ আতিকা (রা.) কে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন। এ পাঁচজনই ছিলেন নবীজির বিখ্যাত সাহাবী। সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারী বিধবা হলেও পরবর্তীতে তার বিয়েটা সহজ ছিল। এসব ব্যাপারে যে ইসলামের কোনো নিষেধাজ্ঞা বা কুসংস্কার নেই, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আতিকা (রা.)।
আতিকা (রা.) এর প্রথম বিয়ে হয় তার চাচাতো ভাই জায়েদ ইবনে খাত্তাব (রা.) এর সাথে। তিনি ছিলেন হযরত উমর (রা.)-এর বড় ভাই। ৬৩২ সালে তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শহিদ হন।
জায়েদ (রা.) ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হলে ইদ্দতকালীন সময় শেষ হলে আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রা.) আতিকার সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আতিকা সম্মত হন এবং দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আবদুল্লাহ (রা.) ছিলেন প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) এর ছেলে এবং আয়েশা (রা.) এর ভাই।
আব্দুল্লাহ (রা.) আতিকা ( রা.) কে অসম্ভব ভালোবাসতেন। হুনাইনের যুদ্ধে পাওয়া একটি আঘাতের কারণে যুদ্ধের কিছুদিন পর শাহাদাত বরণ করেন আব্দুল্লাহ (রা.)। ফলে প্রথম স্বামীর মতোই আতিকা (রা.) এর ২য় স্বামীও শহীদি মর্যাদা লাভ করেন। আব্দুল্লাহ (রা.) আতিকাকে এত গভীরভাবে ভালোবাসতেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর যেন আতিকা আর বিয়ে না করেন -এই শর্তও দিয়েছিলেন। সেইসাথে তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের খরচের জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি বউর নামে রেখে যান।
আবদুল্লাহ (রা.) এর শাহাদাতের পর ইদ্দতকালীন সময় পার হওয়ার পরে আতিকার কাছে আবার অনবরত বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে। তিনি বেশ কয়েকটি বিয়ের প্রস্তাব বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
অনেক প্রস্তাব আসা সত্ত্বেও, আতিকা (রা.) দীর্ঘদিন আর বিয়ে করেন নাই। পরে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অনেক অনুরোধের পর আতিকা (রা.) এ প্রস্তাবে রাজি হন এবং বিয়ে করেন।
উমর (রা.) কে বিয়ের পর আতিকার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আরো বেড়ে যায়। তিনি ইবাদতে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেন। তারা খুব সুখী দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছিলেন। এরপর উমর (রা.)-ও তাঁর আগের দুই স্বামীর মতো মসজিদে এক আততায়ীর ছুরিকাঘাতে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেন।
হজরত উমর (রা.)-এর শাহাদাতের পর ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক ও আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত সাহাবী যুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.)-এর সঙ্গে তাঁর চতুর্থ বিয়ে হয়। উটের যুদ্ধে তিনিও শাহাদাত বরণ করেন।
যুবায়ের (রা.) এর শাহাদাতের পর আতিকা (রা.) রাসূল (সা.) এর নাতি হোসাইনকে বিয়ে করেন। হোসাইন (রা.) ছিলেন আতিকার চেয়ে প্রায় ২০ বছরের ছোট। বয়সের এই পার্থক্য তাদের কনজুগাল লাইফে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। যতদিন একসাথে ছিলেন খুব সুন্দরভাবে জীবন কাটিয়েছেন। এটাই ছিল আতিকা (রা.) এর সর্বশেষ বিয়ে। কারবালার যুদ্ধে হোসাইন (রা.)ও শহীদ হন।
এভাবে একে একে পাঁচজন স্বামীর প্রত্যেকেই শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। প্রতিবার স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হওয়ার পর তিনি পুনরায় বিয়ে করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে এতজন শহীদের স্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য আর কোনো নারীর নেই। তাঁকে উপাধি দেওয়া হয় 'শহীদদের স্ত্রী'।
শাহাদাতের পর আতিকা (রা.) তাঁর প্রত্যেক স্বামীর জন্যই শোকগাথা রচনা করেন। সেসব কবিতার প্রতিটি শব্দ ছিল গভীর বেদনা ও হৃদয়স্পর্শী অনুভূতিতে ভরা। পাঁচজন শহীদের স্ত্রী হয়ে তিনি যেমন দুঃখ-বেদনা বুকে ধারণ করেছেন, তেমনি সাহসের সাথে নতুন জীবন শুরু করার নজিরও স্থাপন করেছেন। তিনি ছিলেন এক প্রেরণাদায়ী নারী, যার জীবনের গল্প চিরকাল ইতিহাসে দীপ্ত হয়ে থাকবে।